গ্রাম-বাংলার একটি গল্প আর একটি আক্ষেপের কথা

একটা গল্প বলি শুনুন। কোন একসময় গ্রামে একটা পরিবার ছিলো যাদের সবাই কানে কম শুনে , মা-বাবা , ভাই-বোন এই চার জন । তো ভাইটাকে বিয়ে দেয়া হল , মজার ব্যাপার হল তার বউটাও কানে কম শুনত ।
বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ি থেকে জামাইকে দুইটা গরু দেয়া হল । একদিন জামাই গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে । হঠাত পুলিশ তাকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলঃ
পুলিশঃ রাম গোপালের বাড়িটা কোনদিকে । ( সে শুনল ; গরু দুইটা কই থাইক্যা চুরি কইরা আনছিস ! )
জামাইঃ না , না স্যার ! সত্যি কইতাছি , গরু দুইটা আমি চুরি করছি না ।
পুলিশঃ (রেগে গিয়ে) আরে! তোরে চুরির কথা কেডায় কইল , আমি তো রাম গোপালরে খুজতাছি !
জামাইঃ (আরো ভয় পেয়ে) সত্যি কইতাছি স্যার , গরু দুইটা আমারে শ্বশুর বাড়ি থাইক্যা দিছে ।

পুলিশ রেগে গিয়ে জামাইকে চরম মাইর দিলো । জামাই রেগেমেগে আসল বাড়িতে তার বউকে ধরতে ।
জামাইঃ ( বউকে ) তোর বাড়ি থাইক্যা আমারে চুরির গরু দিছে , কত্ত বড় সাহস !
এই বলে বউকে মারতে শুরু করল । ওদিকে বউ শুনল যে তার স্বামী কেনো ভাত দেয়া হচ্ছে না সেটা নিয়ে মেরেছে ।
বউঃ কইলাম ভাত ফুইটা গ্যাছে , খালি নামানের বাকি । হ্যার পরও আমারে মারছে । আমি মা’রে আজকে গিয়া বিচার দিমু ।
এই বলে বউ গেলো ছেলের নামে মায়ের কাছে বিচার দিতে –
বউঃ দ্যাখেন আম্মা , আমি কইলাম ভাত হইয়া গ্যাছে তারপরও আফনের ছেলে আমারে ভাতের লাইগ্যা আজকে মারছে , আফনে এইটার বিচার করতেই হইব আজকে ।
মাঃ কি কইলা বউ? তিন দিন হয় নাই এইখানে আসছ আর অখনই আমার সাথে কাইজ্জা ( ঝগড়া ) করতে আসছ ! কউ আমার চুলে ধইরা টান দিতায় । খাড়াও , আজকে যদি আমি তোমার শ্বশুরের কাছে বিচার না দিছি ।
শ্বশুর বাইরে থেকে আসার পর শ্বাশুড়ি তাকে বিষয়টা জানাল –
শ্বশুরঃ আমি অত কাম কইরা অখন খালি আইলাম , আর তুমি কউ জাল লইয়া মাছ মাইরা আনতাম । তোমার মাথা ঠিক আছে নি ?
শ্বশুর খুব রাগ করল , সে তার মেয়েকে গিয়ে বলল কথা গুলো । তার মেয়ে অবাক বিষ্ময়ে (সাথে সামান্য লজ্জায়) তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল –
মেয়েঃ আব্বা ! আফনের কিতা হইসে ? আফনে আমার বিয়ার মাত আমার লগেই মাতুইন ( আপনার কি হয়েছে ? আপনি আমার বিয়ের কথা আমার কাছেই বলেন !!)

এই গল্পটা আমি শুনি আমার এক চাচীর কাছ থেকে । উনার গল্প বলার ধরন দারুন ! সাধারন ভাবে যখন কথা বলেন তখন কোণ সমস্যা নেই , কিন্তু গল্প বলার সময় উনার স্বর একদম নীচুতে নেমে যায় , এতো নীচুতে যে একদম মনযোগ দিয়ে না শুনলে শুনা যাবে না । আগ্রহ ধরে রাখার কি চমতকার উপায় !
আঞ্চলিক ভাষায় বলায় কারন , আমার মনে হল এই গল্পটা যদি সাধারন ভাষায় বলা হত তবে তেমন শুনার মত কোন গল্প হত না !

যাক সে কথা , আমার আক্ষেপের কথা বলি । আমার আব্বার এই সব গল্পের বই সংগ্রহের অনেক ঝোক । সেই সুবাদে এই সব গল্পের অনেক বই পড়া হয়েছে । কিন্তু আমার দাদুর মুখে , বা চাচীর মুখে যেসব গল্প শুনি তা কোথাও খুজে পাইনা । আমার ধারনা হল যেসব বই বেরিয়েছে সেসব আসলে আমাদের লোক গল্পের বিন্দু পরিমান ও না । আমাদের পূর্‌ব-পুরুষেরা তাদের , তাদের ছেলেমেয়েদের মনোরঞ্জনের জন্য না জানি কত কত গল্প বানিয়েছেন । আমরা তার কতটুকুই বা জানি বা শুনছি । এসব গল্প তখন মা-বাবার সাথে , চাচা-চাচী , খালা- খালুর সাথে , দাদা-দাদীয় সাথে কত মধুর সম্পর্‌ক তেৈরি করেছে । আমার পরবর্‌তি প্রজন্ম কে আমি কি বলব । আমি তো এসব জানি না । কার কাছ থেকে জানব ? কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাবে ??

2 comments on “গ্রাম-বাংলার একটি গল্প আর একটি আক্ষেপের কথা

  1. আশাবাদী বলেছেন:

    মুখে মুখেই হয়তো চলবে কিছু আর বাকিগুলো হারিয়ে যাবে, হয়তো নতুন কিছু গল্প তৈরি হবে।

    তবে আমরা বহুদিন পর্যন্ত নানী/দাদি বা গুরুজনদের কাছে বড় হয়েছি, এখন এমন ছোট ছোট পরিবার যে ছেলেমেয়েরা দাদি/নানীর কাছে না থেকে কাজের লোকদের কাছে থাকে আর এদের কাছেই বা কি গল্প শুনবে? এভাবেই গল্প হারিয়ে যাবে।

    • কাজের লোকদের কাছে থেকে যে শুধু এটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাই না , নানা রকম কুসংস্কার , ভূত – প্রেত এইসব বিশ্বাস করা ও শিখছে …

      মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান